
ফেনডম সেশনের নামে নির্যাতন, ফের পর্ণোগ্রাফির চক্রে সক্রিয় রাব্বিরা
নিজস্ব প্রতিবেদক :রাজধানীর গুলশান, বাড্ডা এলাকায় পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন। এসব সন্ত্রাসীরা সরকার পতনের আগে ছাত্র জনতার উপর হামলায় অংশ নিয়েছিল। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন বোল পাল্টিয়ে প্রকাশ্যে আবারো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বাসা বাড়িতে ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটনানোর অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাব্বী নামের একটি বেসরকারি বিশ্বদ্যালয়ের ছাত্র। গত ৫ জুলাইয়ে ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় রাজধানীর গুলশান, বনানী, ভাটারা-বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের অংশ গ্রহণ করেছিলেন রাব্বীর নেতৃত্বে বেশী কিছু সন্ত্রাসী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি জামায়াতের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের অপকর্ম আড়ালের অপচেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা এলাকার বিভিন্ন নামি দামি ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত ছাড়াও তরুণীদের নিয়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, বহুল আলোচিত একজন মডেলের সঙ্গে তার দহরম মহরম ছিল তার।
অভিযোগে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ১১ জানুয়ারি গুলশানের ২৯ নম্বর সড়কের একটি বাসায় যৌথবাহিনীর পরিচয়ে অভিযানের নামে ৭ থেকে ৮ জন ব্যক্তি প্রবেশ করে। তারা সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই বাসার সব কিছু লুট করে পালিয়ে যায়। পরে ভুক্তভোগি থানায় ৬০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৪০ লাখ টাকা লুটের অভিযোগ করেন। তবে ঘটনার পর ওই ভুক্তভোগি বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারে অনিহা প্রকাশ করেছেন।
গত ২১ জানুয়ারি একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের পাশেই প্রধান সড়ক দিয়ে শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ১৫ থেকে ২০ জন লোক তার গতিরোধ করে তাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে প্রায় কোটি টাকা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যান তারা। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, সন্ত্রাসী ইয়াসিন ও তার সহযোগীরা ঘটিয়েছেন এ ঘটনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগি জানান, গত বছরের জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জাহিদ হোসেন ওরফে রাব্বি জড়িত ছিলেন। তিনি এক সময় নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিতেন। জামালপুর সদরের কৃষ্ণচন্দ্রপুরে তাদের বাড়ি। আর এজন্য আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মির্জা আজমের আত্মীয় পরিচয় দিতেন। তিনি এখন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গোপনে বসবাস করছেন। আর কনকর্ড গ্রুরে একজন সেলস এক্সিকিউটিব হিসেবে কর্মরত। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিক ও পলাতক মির্জা আজমের কাছের লোক হওয়ায় নানা অপকর্ম করেও বহাল তবিয়তে থাকছেন। তার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার অভিযোগ থাকলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এছাড়াও জুলাই হত্যাকান্ডে খিলগাঁও থানার তালতলা মার্কেট এবং শহীদ বাকী রোডে ৩৮১/বি, আপন কপি হাউসের সামনে সংঘটিত ঘটনায় জাহিদ হোসেন রাব্বি সরাসরি জড়িত বলে বেশ ক’জন প্রত্যক্ষদর্শী জানান। খিলগাঁও শহীদ বাকী রোডের স্থানীয় অধিবাসী ও ব্যবসায়ী সালমান খান বলেন, আপন কপি হাউসের সামনে এই রোডে জুলাই আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর রাব্বী তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সরাসরি হামলা করেছিল। আন্দোলনের সময়ে বেশ কিছুদিন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গুন্ডাদের নিয়ে নিরীহ ছাত্র ছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সেসময় জাহিদ হোসেন রাব্বি খিলগাঁওয়ে বসবাস করতো। পান সিগারেটের দোকানী জলিল মিয়া বলেন, সেসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর রাব্বির চোখ রাঙ্গানো হামলা আমরা ভুলতে পারি না।
জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে খিলগাঁওয়ের শহীদ হওয়া ছাত্রদের রক্তের দায় কোনভাবেই এড়াতে পারেন না এই রাব্বি- এমন কঠোর মন্তব্য করেন আরেক স্থানীয় অধিবাসী আলতাফ হোসেন।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর গুলশান-বাড্ডা-খিলগাঁয়ে পর্ণোগ্রাফীর চক্র গড়ে তোলা কথিত মো: জাহিদ হোসেন রাব্বি আন্দোলনের পর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কিছুদিন আত্নগোপনে ছিলো। এরপর সে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের স্রোতে মিশে যেতে থাকে। এখন সে বসুন্ধরা আবাসিকেও তার পর্ণোগ্রাফি ব্যবসাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফ্যান্টাসী কিংডমের জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকুরীর সুবিধা নিয়ে রাব্বি এখন খিলগাঁও-বসুন্ধরা-গুলশান-বাড্ডায় ফেমডম সেশনের নামে নির্যাতন ও পর্ণোগ্রাফীর চক্র গড়ে তুলছে। এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মো: জাহিদ হোসেন রাব্বি উত্তেজিত কন্ঠে বলেন, যা পারেন করেন। আমার কিছু যায় আসে না। এরপর ফোন লাইন কেটে দেন।
পুলিশের গুলশান বিভাগের নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তিনি বসবাস করার কারণে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মদ্যপান, ইয়াবা,গাঁজা,ক্রিস্টাল আইসসহ নতুন ধরণের মাদকে আসক্ত করানো হয়। আর সেখানে অনেকের গোপনে অন্তরঙ্গ ছবি তুলে ব্ল্যাক মেইলিং করার অভিযোগ রয়েছে।
অপর এক সূত্র জানায়, ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় ৪টি মোটরসাইকেল যোগে ১০ থেকে ১৫ জন সন্ত্রাসী এসে জাতীয়তাবাদী চালক দলের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকারের পায়ে গুলি করে। পরে ফাঁকা গুলি করতে করতে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। ঘটনার পর হাসপাতালে জুয়েল জানান, একটি সমিতির টাকা বিতরণ চলছিল। এ সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী রবিন মাহবুব পরচিয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তাদেরকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ১০ মিনিট পর লোক পাঠিয়ে তাকে গুলি করে। এঘটনায় প্রথমে মামলা করলেও পরে ভয়ে মামলা তুলে নেন জুয়েল। গুলশানে একের পর এক ডাকাতি ও গুলির ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছে বাসিন্দারা।
অপরদিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফেমডম সেশনের নামে নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি প্রচারের অভিযোগে দুই নারীকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির ভাটারা থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, শিখা আক্তার (২৫) ও সুইটি আক্তার জারা (২৫)। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি-ব্লকের একটি বাসায় অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে বিকৃত যৌনতার কাজে ব্যবহৃত একটি চাবুক, পরিধেয় বিশেষ পোষাক, হাই হিল বুট জুতা ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, জনৈক আব্দুল্লাহ গত ২৯ এপ্রিল ফেসবুকের মাধ্যমে একটি অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে। সেখানে পুরুষদের উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন ও বিকৃত যৌনাচারের ভিডিও প্রচার করা হয়। এই কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিরা টেলিগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। জড়িত নারীরা নিজেদের ‘মিসট্রেস’ হিসেবে পরিচয় দেন এবং পুরুষরা টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে নির্যাতিত হতে আগ্রহী হন, যা ‘ফেমডম সেশন’ নামে পরিচিত। ভুক্তভোগি আব্দুল্লাহ শিখা আক্তার নামে একজনের সঙ্গে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন এবং তাদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৫০০ টাকা প্রদান করেন। পরে তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় যেতে বলা হয়। আব্দুল্লাহ গত ৩০ এপ্রিল সেখানে যান। এরপর দেখতে পান শিখা আক্তার ও সুইটি আক্তারসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন একজন পুরুষকে উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন করছেন এবং মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছেন। এ ঘটনায় বাদী আব্দুল্লাহর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেছেন, ‘গুলশান, বারিধারা কূটনেকি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানে আমাদের নিয়মিত পুলিশি তৎপরতার বাইরেও একটু বেশি তৎপরতা থাকে। অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা আইনের আওতায় আসবে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সেই ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করে সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তা নিয়ে যে সংশয় আছে, সেটি দূর করার চেষ্টা করতে হবে। শুধু কাগজে চেকপোস্ট টহলের তথ্য না দিয়ে মাঠেও কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।