আশ্রাফুল আলম নোবেল পাটোয়ারী : ফেনীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে চলছে প্রকাশ্যে রমরমা ঘুসবাণিজ্য ।
একটা দালালচক্রের সিডিকেটের হাতে জিম্মি । তাদের সাইনবোর্ড দেখে বাইরে থেকে মনে হবে ট্রাভেল এজেন্সি , স্টুডিও, কম্পিউটার বা ফটোকপির দোকান-কিন্তু ভেতরে ‘ব্যবসা’ ভিন্ন। ফেনীতে এভাবেই সাইনবোর্ডের আড়ালে চলছে পাসপোর্ট নিয়ে জাল-জালিয়াতির রমরমা কারবার। ভুয়া সিল-প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হয় যাবতীয় নকল কাগজপত্র। টাকার বিনিময়ে সহজেই মেলে পাসপোর্ট। শহরের ৫০টি ট্রাভেল এজেন্ট ও খোদ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনের দোকানঘর ঘিরেই তৎপর পাসপোর্ট দালাল চক্রের সদস্যরা। সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতির এসব তথ্য।
ফেনী পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সাধন সাহা এ অফিসের ঘুসবাণিজ্যের কথা অস্বীকার করেন। তবে দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। দালাল নির্মূলে অফিসের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য জেলা পুলিশের সহায়তায় মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হয়। আশা করছি ধীরে ধীরে সমাধানে যেতে পারব। এ অফিসে প্রতিদিন গড়ে ২০০ পাসপোর্টের আবেদন জমা পড়ে বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনীর প্রায় ৫০ জন চিহ্নিত দালাল নিজেদের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের রেজিস্ট্রার্ড এজেন্ট বলে পরিচয় দেন। বেশির ভাগ পাসপোর্ট প্রত্যাশী ই-পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে গিয়ে এদের ফাঁদে পড়ছেন। দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তারা। চুক্তি না হলে বিড়ম্বনার শিকার হবেন বলেও জানান।
পাসপোর্টসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নেন দালালরা। সিরিয়াল ছাড়া আবেদন জমা করতে ৫ থেকে ১৫ হাজার, পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২০ হাজার, নামের বানান সংশোধনে সর্বনিম্ন ২৫-৩০ হাজার এবং জন্মতারিখ সংশোধন ও নামপরিবর্তন বা ভুয়া নাম-ঠিকানায় জাল পাসপোর্ট তৈরি, আঙুলের ছাপ জালিয়াতি (মিস ফিঙ্গারিং) ইত্যাদি কাজ বাবদ ৩০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ পাসপোর্ট অফিস কেন্দ্র করে শুধু দালালদের মাধ্যমেই বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ঘুসবাণিজ্য হয়। অফিসে ট্রাভেল এজেন্টদের লোক রয়েছে। গ্রাহকের পাসপোর্টসংক্রান্ত সমস্যা শুনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তারা ফোন দেন। সবুজ সংকেত পাওয়ার পর তারা কাজ শুরু করেন।
শহরের একাধিক ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে এ পাসপোর্ট অফিসে দালালদের প্রশ্রয়দানের কথা জানা গেছে। অনলাইনে পূরণ করা পাসপোর্টের ফরমের ওপর ওইসব এজেন্টের সিল দেওয়া হয়। সিল থাকলে পাসপোর্ট অফিসের লোকজন বুঝতে পারেন এটি তাদের তালিকার সিল। প্রতিদিন বিকালে আনসার সদস্য করিম তালিকা ধরে প্রতি জমা আবেদনের জন্য এক হাজার ২০০ টাকা করে নিয়ে যান। সেই টাকা বুঝিয়ে দেন অফিসের সহকারী হিসাবরক্ষক আবুল নেসুর, অফিস সহকারী মাফতুল হোসেন ও ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোলার অপারেটর সাইফুল লতিফকে। তাদের মাধ্যমে অফিসের কর্মকর্তাদের পদ অনুসারে টাকার হিস্যা অনুপাতে বণ্টন করা হয়।
গত মাসে এ পাসপোর্ট অফিসে হয়রানির শিকার হয়ে একদল গ্রাহক ফেনী পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজির কাছে অভিযোগ করেন। তিনি তাৎক্ষণিক ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে অভিযোগের সত্যতা পান। এ সময় ফেনীর শত শত গ্রাহক মেয়রকে তাদের হয়রানির কথা জানান।
নাম প্রকাশ না করার শতে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে এখানে সিন্ডিকেট নেটওয়ার্কটির দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী হিসাবরক্ষক আবুল নেসুর, অফিস সহকারী মাফতুল হোসেন ও ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোলার অপারেটর সাইফুল লতিফ। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এ চক্রটি ঘুসবাণিজ্য চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অফিস সহকারী মাফতুল বলেন, এ নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। যা বলার তা পরিচালক বলবেন।
এ ব্যাপারে জানতে অপারেটর সাইফুলকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি তা ধরেননি।
আনসার সদস্য করিম বলেন, আমি এখন এ অফিসে নেই। তখন মাঝে মাঝে স্যারদের কিছু কাজ করেছি।