আশ্রাফুল আলম নোবেল পাটোয়ারী :নীতি সুদহার বাড়লো, আমানত সুদের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার
মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে আমানতের সুদ হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে বাজারে নগদ টাকার সরবরাহ কমাতে ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের মুদ্রানীতিকে সতর্কমূলক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার (১৫ জানুয়ারি) আগামী ছয় মাসের জন্য এমন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যাকে সংযত পদক্ষেপ উল্লেখ করে গর্ভনর জানিয়েছেন, ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল ভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো হবে এই সময়ে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরও কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করেছে ‘সতর্কমূলক ও একোমোডেটিভ’ মুদ্রানীতি।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ষান্মাসিক মুদ্রানীতি (মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট –এমপিএস) আগামী ১৫ জানুয়ারি ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হার চাপ নিয়ন্ত্রণ, প্রবৃদ্ধি সহায়ক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মেয়াদী রেপোর সুদ হার পাঁচ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ছয় শতাংশ করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের জুন মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়েও রেপো সুদদহার বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রিভার্স রেপো হার আগের চার শতাংশ থেকে চার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
ব্যাংক রেট চার শতাংশ ও বিশেষ রেপো হার আট দশমিক ৭৫ শতাংশ আগের জায়গাতেই রাখা হয়েছে।
রোববার (১৫ জানুয়ারি) বিকেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বেলা আড়াইটায় এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
২০২৩ সালের জন্য জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মুদ্রানীতি ঘোষণা করে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, আমরা একটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি।
ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয় তাকে বলে ব্যাংক রেট।
এসব নীতি হারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য প্রবাহ আর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে। যাতে বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়। আবার বাজারে পণ্যমূল্যও সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়।
রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে।
গত বছরের ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এক বছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। যেখানে ভঙ্গি ছিল ‘সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ ও কিছুটা সংকোচনমুখী’।
কিন্তু আইএমএফ এর পরামর্শে আবারও ছয় মাস সময়ের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণার পথে ফেরে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতির যে প্রক্ষেপন গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে ধরে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, সেই তথ্য উপস্থাপন করে অর্জন সম্পর্কে বলা হয়, এই সময়ে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৩.৩ শতাংশ, অর্জন হয়েছে ২৬. ৬ শতাংশ।
আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৩.৬ শতাংশ, হয়েছে ১২.৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬ .৯ শতাংশ, আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়েছে ১৫ .১ শতাংশ।
মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ, হয়েছে ৮.৪ শতাংশ।
জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনার নির্ধারণ করে সরকার।
আর জানুয়ারি-জুন-২৩ সময়ের জন্য যে মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা হয়েছে, এই সময়ে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৭.৭ শতাংশ, গত বছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে আগমী জুন পর্যন্ত যা ধরা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ। এখানে একটু প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হয়েছে।
আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, গত বছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও আগমী জুন পর্যন্ত যা ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ।
সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ, গত বছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে আগমী জুন পর্যন্ত যা ধরা হয়েছিল ১৮.২ শতাংশ। এখানে একটু প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১.৫ শতাংশ, এখানে একটু প্রবৃদ্ধি গত বছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে আগমী জুন পর্যন্ত যা ধরা হয়েছিল ১২.১ শতাংশ। এখানে একটু প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে।
জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনার নির্ধারণ করে সরকার।
গত ৩০ জুন মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরও কমাতে রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ‘সংকোচনমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। তখন বলা হয়েছিল এ মুদ্রানীতি হবে এক বছর মেয়াদের, যা জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে।
ওই মুদ্রানীতির ছয় মাস শেষ হয় ডিসেম্বরে। এক সময়ে ছয় মাসের জন্যই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হতো। ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রচলন শুরু করেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির।
বছরে আগের মতো দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে পরামর্শ এসেছিল ঋণ নিয়ে ঢাকায় আলোচনা করতে আসা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দলের কাছ থেকেও। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়ে ছয় মাসের মুদ্রানীতি করার কথা বলেছিল। সেটির আলোকেই আগামী ১৫ জানুয়ারিতে ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।
‘সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ ও কিছুটা সংকোচনমুখী’ ঠিক করে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল।
সেখানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ যোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তাতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৯. ৪ শতাংশ, যা গতবার ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল।
আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, যা গতবার ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ র্নিধারণ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: আইএমএফের ঋণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে ৩১ জানুয়ারি
মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, গতবার এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ।
জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনার নির্ধারণ করে সরকার।
কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।